মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা: জয়ের কাহিনি ও উৎসবের রূপ
দুর্গাপূজা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু উৎসব, যা বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসাম, বিহার এবং বাংলাদেশে মহাধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হয়। এই উৎসব শুভের ওপর অশুভের জয়ের প্রতীক, যেখানে দেবী দুর্গা অসুররাজ মহিষাসুরকে বধ করে ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুর্গা শক্তি, সাহস ও করুণার প্রতীক হিসেবে পূজিত হন, যিনি ভক্তদের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেন।
আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যের পাশাপাশি দুর্গাপূজা এক সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। এটি মানুষকে একত্রিত করে, শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য ও সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ এনে দেয়।
দুর্গাপূজার পেছনের কাহিনি
দেবী মহাত্ম্য অনুসারে, মহিষাসুর ছিলেন এক অসুররাজ যিনি দেবতাদের বর পেয়ে অজেয় হয়ে ওঠেন এবং স্বর্গ-মর্ত্যে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। কোনো দেবতাই তাকে পরাজিত করতে পারেননি। তখন দেবতারা তাঁদের শক্তি মিলিয়ে সৃষ্টি করেন দেবী দুর্গার—সর্বশক্তিমান দেবী, যিনি দেবতাদের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সিংহে আরোহণ করে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। টানা দশ দিনের যুদ্ধ শেষে বিজয়াদশমীতে দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। এই কারণেই দুর্গাপূজা শুভ ও অশুভের চিরন্তন সংগ্রামের প্রতীক।
দুর্গাপূজা যেভাবে উদযাপিত হয়
- প্রস্তুতি (মহালয়া): দুর্গাপূজার সূচনা হয় মহালয়া দিয়ে। এদিন দেবীকে আহ্বান করা হয় মন্ত্রপাঠ, চণ্ডীপাঠ ও ভজনের মাধ্যমে। প্রতিমাশিল্পীরা এই দিনেই দেবীর চোখ অঙ্কনের (চক্ষুদান) প্রথা শুরু করেন।
- প্রতিমা গঠন: মাটির তৈরি প্রতিমাই এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। দেবীকে সাধারণত দশভুজা, সিংহে আরোহিনী, হাতে দেবতাদের প্রদত্ত অস্ত্রধারিণী এবং মহিষাসুর-বধের ভঙ্গিতে চিত্রিত করা হয়।
- প্যান্ডেল পরিদর্শন: নানা থিম ও শিল্পকর্মে সজ্জিত অস্থায়ী প্যান্ডেলে দেবী দুর্গার প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মানুষ ভিড় জমায় সেই শিল্পকলা উপভোগ করতে ও পূজা দিতে।
- ষষ্ঠী থেকে দশমীর পূজা: ষষ্ঠীতে প্রতিমা উন্মোচনের পর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে পূজা, পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ ও আরতি অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যা দেবীর ভয়ংকর রূপ ধারণের মুহূর্তের স্মারক।
- ধুনুচি নাচ: ধূপভর্তি ধুনুচি হাতে দেবীর উদ্দেশে নৃত্য পরিবেশনের এই প্রথা সন্ধ্যারতি সময় অনন্য ভক্তিভাব প্রকাশ করে।
- বিজয়াদশমী: দশমীতে দেবীর বিসর্জন হয় নদী বা জলাশয়ে। শোভাযাত্রা, গান-বাজনা, নৃত্যের মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। এদিন বিবাহিতা মহিলারা সিঁদুর খেলা প্রথায় অংশ নেন।
- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: পূজাকে ঘিরে আয়োজন করা হয় নাটক, সংগীত, নৃত্য ও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
- আনন্দভোগ ও মিলন: নতুন পোশাক পরা, বিশেষ খাবার যেমন খিচুড়ি, লুচি, রসগোল্লা, সন্দেশ প্রভৃতি ভোগ ও ভোজনে উৎসবের আনন্দ বহুগুণ বাড়ায়।
উপসংহার
দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহোৎসব। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শুভশক্তি সর্বদা অশুভকে পরাজিত করে এবং সমাজের ঐক্য, আনন্দ ও আশার নবীকরণে একত্রিত হওয়া কতটা প্রয়োজনীয়।
Comments
Post a Comment