মহালয়া: এর গুরুত্ব এবং উদযাপনের বিশদ বিবরণ

 


মহালয়া একটি পবিত্র দিন যা দুর্গা পূজার সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মূলত বাংলায় এবং ভারতের অন্যান্য অংশে উদযাপিত হয়, যেখানে দুর্গা পূজা প্রচলিত। মহালয়ার বিশেষ স্থান রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ে, কারণ এটি শুভ শক্তির দ্বারা অসুর শক্তির পরাজয়ের প্রতীক। দুর্গা পূজার ঠিক সাত দিন আগে মহালয়া পালিত হয় এবং এই দিনটিতে বিশ্বাস করা হয় যে, দেবী দুর্গা কৈলাস পর্বত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ শুরু করেন, যেখানে তিনি তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হন। এটি দেবীকে পৃথিবীতে আহ্বান জানানোর দিন এবং অসুর শক্তিকে ধ্বংস করার আহ্বানও।


হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দুর্গা পূজা দেবী দুর্গার মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্মরণে পালিত হয়। এই সময়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার শক্তি এবং শক্তিকে আহ্বান করেন, তার আশীর্বাদ এবং সুরক্ষা কামনা করেন। মহিষাসুর মর্দিনী কাহিনী, যেখানে দেবী মহিষাসুরকে পরাজিত করেন, এই উৎসবের মূল বিষয়।


এছাড়াও, মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিনে পালিত হয়, যা ১৬ দিনব্যাপী পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়। এই দিনে তর্পণ নামক এক বিশেষ আচার পালিত হয়, যেখানে ভক্তরা তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা, জল এবং খাদ্য অর্পণ করেন।


মহালয়ার বিশদ উদযাপন


১. মহিষাসুর মর্দিনী স্তোত্র পাঠ

মহালয়ার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল ভোরবেলা মহিষাসুর মর্দিনী স্তোত্র পাঠ। এটি একটি স্তোত্র যা দেবী দুর্গার মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তার বিজয়ের কাহিনী বলে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এই স্তোত্রটি রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়, যা মহালয়ার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃত মন্ত্র এবং ভক্তিমূলক গানের সংমিশ্রণে এই স্তোত্র পাঠ ভক্তদের মাঝে এক ধরণের আধ্যাত্মিকতা এবং ভক্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে।


মানুষ ভোরের আগে ঘুম থেকে উঠে রেডিও বা টিভির সামনে বসে এই স্তোত্র পাঠে মগ্ন হন। এটি শুধুমাত্র একটি প্রথা নয়; বরং এটি অনেকের জন্য একটি আবেগপূর্ণ মুহূর্ত, যা তাদের পরিবারের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্মৃতি জাগ্রত করে।


২. তর্পণ আচার

মহালয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন যখন তর্পণ আচার পালিত হয়, যা মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে পিতৃপক্ষের সময় পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীর কাছাকাছি আসে এবং এই তর্পণ আচার তাদের আশীর্বাদ কামনা করে। ভক্তরা, বিশেষত পুরুষরা, নদী, পুকুর বা অন্যান্য জলাশয়ের তীরে গিয়ে জল, তিল, চাল এবং ফুল দিয়ে মন্ত্রপাঠ করেন।


পুরোহিতের সাহায্যে এই তর্পণ আচার সম্পন্ন হয়, যারা ভক্তদের সঠিকভাবে আচারটি সম্পন্ন করতে সহায়তা করেন। এটি একটি গম্ভীর অনুষ্ঠান, যা পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি নিশ্চিত করার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের আশীর্বাদ কামনা করার উদ্দেশ্যে পালিত হয়।


৩. দুর্গা পূজার প্রস্তুতির সূচনা

মহালয়ার দিন থেকেই দুর্গা পূজার প্রস্তুতি শুরু হয়। এই দিনের পর থেকে আনন্দ এবং উৎসবের আবহ তৈরি হয়। বাংলার রাস্তাগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্যান্ডেল তৈরির কাজ শুরু হয়। শিল্পীরা দুর্গা এবং তার সন্তানদের—লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশের মূর্তিগুলির চূড়ান্ত স্পর্শ দেন। মূর্তিগুলিকে রঙিন এবং অলঙ্কৃত করা হয়, পূজামণ্ডপে তাদের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত করা হয়।


ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হয়, এবং লোকেরা নতুন পোশাক ও উপহার কিনতে শুরু করেন, কারণ পূজার দিনে নতুন পোশাক পরার প্রচলন রয়েছে। রাস্তা, বাজার এবং শপিং মলগুলিতে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। মহালয়ার পর থেকেই দুর্গা পূজার উত্তেজনা এবং আনন্দ বাড়তে থাকে।


৪. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পরিবেশনা

মহালয়া দেবী দুর্গার আগমনকে উদযাপন করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও উপলক্ষ। এই পরিবেশনাগুলি সাধারণত দুর্গার মহিষাসুরকে পরাজিত করার কাহিনী নৃত্য-নাট্য, নাটক এবং সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে উপস্থাপন করে। কিছু এলাকায় বড় বড় কমিউনিটি ইভেন্ট আয়োজন করা হয়, যেখানে লোকেরা একত্রিত হয়ে দেবীর শক্তি, কৃপা এবং করুণার গল্পগুলি উদযাপন করে।


দেবীর অসুরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার বিজয়ের পৌরাণিক কাহিনী এই অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে পুনরায় বলা হয়, যা ভক্তদের সাথে গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করে। এই ধরনের পরিবেশনাগুলি দুর্গা পূজার দিনগুলিতেও চালু থাকে, যা উৎসবের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে।


৫. আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এবং ভক্তিমূলক প্রথা

ভক্তরা মহালয়ার দিনটি প্রার্থনা এবং ভক্তিতে কাটান। অনেকেই মন্দিরে গিয়ে দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন এবং আসন্ন পূজার প্রস্তুতি নেন। কেউ কেউ উপবাস পালন করেন, আবার কেউ বিশেষ প্রসাদ তৈরি করে দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। এই দিনটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির একটি সময় হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে ভক্তরা মানসিক এবং শারীরিকভাবে আসন্ন পূজায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হন।


৬. নবরাত্রির সূচনা

ভারতের অনেক অংশে মহালয়ার পরপরই নবরাত্রি উৎসব শুরু হয়, যা দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের পূজার জন্য নয় দিনব্যাপী পালিত হয়। গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলিতে নবরাত্রি উপবাস, ভক্তি এবং বিখ্যাত গরবা ও দাণ্ডিয়া রাস নাচের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। যদিও মহালয়া মূলত পূর্ব ভারতে দুর্গার পৃথিবীতে অবতরণকে কেন্দ্র করে, ভারতের অন্যান্য অংশে এটি নবরাত্রির উৎসবের সাথে সহজেই মিলিয়ে যায়।


উপসংহার

মহালয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন যা ভক্তি, আচার, সাংস্কৃতিক প্রকাশ এবং দুর্গা পূজার প্রস্তুতিকে একত্রিত করে। এটি আত্মজিজ্ঞাসা, পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং আনন্দময় প্রত্যাশার সময়, যখন দেবী দুর্গাকে পৃথিবীতে আহ্বান করা হয়, যাতে তিনি তার ভক্তদের আশীর্বাদ করেন।


Comments

Popular posts from this blog

Olympics24 : Julien Alfred of St Lucia becomes fastest woman on earth by winning 100 mtrs

Sporting icons : Mats Wilander - Career HLs & video of Swede Tennis great

Sporting heroes : Jim Courier - career HLs & video of top tennis stars