মহিষাসুর মর্দিনী: মহালয়ার দিন বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা এক ঐতিহ্য

 


রেডিও প্রোগ্রাম "মহিষাসুর মর্দিনী" পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত সম্প্রচার, যা মহালয়া দিনে দুর্গাপূজা উৎসবের সূচনা করে। মহালয়া মূল পূজার সাত দিন আগে পালিত হয় এবং প্রতি বছর আকাশবাণী (এআইআর) এই অনুষ্ঠানটি প্রচার করে। এই অনুষ্ঠানটি লক্ষ লক্ষ বাঙালির কাছে অত্যন্ত মূল্যবান একটি ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। এর উৎপত্তি ১৯৩০-এর দশক থেকে, যা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।


ঐতিহাসিক পটভূমি:


ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে, ১৯৩০-এর দশক ছিল সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগ। বিশেষ করে বাংলা তখন সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে শিল্পী, কবি, এবং চিন্তাবিদরা গভীরভাবে আঞ্চলিক পরিচয় পুনর্গঠনে লিপ্ত ছিলেন। দুর্গাপূজা, যা একটি প্রাচীন উৎসব, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং এটি শুভ ও অশুভের চিরন্তন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। তবে, এই মহান উৎসব তখনও সমসাময়িক কোন আধুনিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি।


১৯৩১ সালে আকাশবাণী কলকাতা তার শুরুর দিনগুলিতে ছিল, এবং তখন রেডিওও ভারতে এক নতুন গণমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল। আকাশবাণী, কলকাতা সেই সময় উপলব্ধি করেছিল যে, রেডিওর মাধ্যমে বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব, বিশেষ করে দুর্গাপূজার মতো উৎসবের সময়ে মানুষের মনে একটা প্রভাব তৈরি করা যাবে।


"মহিষাসুর মর্দিনী"র সৃষ্টি:


"মহিষাসুর মর্দিনী" প্রোগ্রামের সৃষ্টির কৃতিত্ব মূলত তিনজন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়—বাণী কুমার (গীতিকার ও নাট্যকার), পঙ্কজ কুমার মল্লিক (প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক), এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (বিখ্যাত বাঙালি মঞ্চশিল্পী)। এই তিনজন মিলে এমন একটি অডিও অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিলেন, যেখানে সংস্কৃত শ্লোক, বাংলা ভক্তিমূলক গান এবং দেবী দুর্গার মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাহিনীর বর্ণনা সমন্বিত ছিল।


বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আবেগময় কণ্ঠস্বর এই প্রোগ্রামের প্রাণ হয়ে উঠেছিল। তাঁর গভীর আবেগপূর্ণ কণ্ঠ দুর্গার বিজয়ের কাহিনীকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল যে, এটি মহালয়া প্রথার একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল।


পঙ্কজ কুমার মল্লিক ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে আধুনিক স্পর্শের মিশ্রণ ঘটিয়ে সুরারোপ করেছিলেন, যা বর্ণনার আবেগকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।


বাণী কুমার সম্পূর্ণ প্রযোজনাটির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন, যেখানে প্রাচীন পুরাণের সঙ্গে আধুনিক বোধের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল। তাঁর লেখা শুধুমাত্র ধর্মীয় আবৃত্তি ছিল না, বরং এটি একটি থিয়েট্রিক্যাল ও সঙ্গীতময় অভিজ্ঞতা ছিল, যা মানুষের মনে ভক্তি উদ্রেক করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক এক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল।


প্রথমবার এই অনুষ্ঠানটি ১৯৩১ সালে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এর মূল বিষয়বস্তু ছিল দেবী দুর্গার মহিষাসুরের বিরুদ্ধে বিজয়, যা শ্রোতাদের কাছে শুভ ও অশুভের চিরন্তন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, এই বার্তা তখন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।


প্রভাব এবং উত্তরাধিকার:


যা একটি রেডিও পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা দ্রুতই এক বিপ্লব ঘটায়। এই প্রোগ্রামটি শ্রোতাদের ধর্মীয় দিক ছাড়াও সাংস্কৃতিক প্রতীকী অর্থে গভীরভাবে স্পর্শ করে। "মহিষাসুর মর্দিনী" সময়ের সাথে সাথে মহালয়ার সকালে বাঙালির ঘুম ভাঙানোর একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রতিটি বছর ভোর ৪টার দিকে মানুষ এই অনুষ্ঠান শুনতে আগ্রহী হয়ে রেডিওর সামনে বসে পড়ে।


এই প্রোগ্রামটি চণ্ডীপাঠ আকারে গঠিত, যেখানে "চণ্ডী" গ্রন্থের শ্লোক পাঠ করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রতীকী কণ্ঠ, গান এবং শ্লোকের সাথে মিশে এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা শুধুমাত্র কাহিনী বলার গণ্ডি পেরিয়ে এক ধ্যানমগ্ন অভিজ্ঞতা তৈরি করে।


বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মৃত্যুর পরেও তাঁর কণ্ঠস্বরের অনুষ্ঠানের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা আজও অটুট। ১৯৭৬ সালে আকাশবাণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিবর্তে বিখ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমারের কণ্ঠে নতুন সংস্করণ প্রকাশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া এতটাই নেতিবাচক ছিল যে, পরের বছরই আসল সংস্করণটি পুনঃপ্রচারে আনা হয়। এটি আরও প্রমাণ করে, মানুষ কতটা আবেগ নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ এবং তাঁর কাহিনী বলার ধরনকে আপন করে নিয়েছে।


আধুনিক যুগ:


যদিও টেলিভিশন এবং অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসার ঘটেছে, তবুও "মহিষাসুর মর্দিনী" আজও বাঙালির হৃদয়ে এক পবিত্র স্থান ধরে রেখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পুনরায় মাষ্টার করা সংস্করণ এবং অনলাইন স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে এটি আরও সহজলভ্য হয়ে উঠলেও মূল সম্প্রচারের আত্মা অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি বছর মহালয়ার সকালে একই উত্তেজনা বিরাজ করে যখন মানুষ ঐতিহ্যের এই প্রিয় কণ্ঠ এবং সঙ্গীতের পুনরুদ্ধার শুনতে রেডিওর সামনে বসে।


উপসংহার:


মহালয়ার দিনে "মহিষাসুর মর্দিনী"র সৃষ্টি শুধুমাত্র একটি রেডিও প্রোগ্রামের জন্ম নয়, বরং এটি একটি ঐতিহ্যের জন্ম, যা প্রায় এক শতাব্দী ধরে টিকে আছে। এটি শিল্প, ভক্তি এবং সাংস্কৃতিক গল্প বলার এক চমৎকার মিশ্রণ, যা পুরাণের শিকড়ের সঙ্গে আধুনিক মাধ্যমের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং বাণী কুমারের মতো সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, যা এক সময়ের একটি পরীক্ষামূলক সম্প্রচার ছিল, তা আজ বাঙালি পরিচয় ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।


Comments

Popular posts from this blog

Olympics24 : Julien Alfred of St Lucia becomes fastest woman on earth by winning 100 mtrs

Sporting icons : Mats Wilander - Career HLs & video of Swede Tennis great

Sporting heroes : Jim Courier - career HLs & video of top tennis stars